অপ্রিয় সত্য
![]() |
অপ্রিয় সত্য |
সাম্প্রতিক
সময়ে ‘জিহাদ’ শব্দটি পত্রিকাগুলোতে প্রায়ই ব্যবহার করতে দেখা যায় ‘জিহাদি বই’ স্টাইলে। জিহাদ কি এবং কেন আর
জিহাদ বলতে আসলেই কি বুঝায় তা অধিকাংশ মুসলমান জানেন না। যারা জানেন তাদের
অধিকাংশই আংশিক জানেন, প্রকৃত অর্থ জানেন না। এই ‘জিহাদ’ শব্দটি নিয়ে কম পানি ঘোলা করা
হয়নি আর বর্তমান প্রজন্মের নিকট ‘জিহাদ’ শব্দটিকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে যেন তারা শুধু মনে করে অন্যায়ভাবে
মানুষ হত্যা করাটাই হচ্ছে ‘জিহাদ’! অর্থাৎ বর্তমান প্রজন্ম ‘জিহাদ’ শব্দটির ক্ষেত্রে একপ্রকার ঘৃণা হৃদয়ে ধারণ করে বড় হচ্ছে। আর তাদের
হৃদয়ে এই ধারণা বদ্ধমূল হওয়ার পিছনে রসদ যোগাচ্ছে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম, ইসলাম বিদ্বেষীদের লেখা যেখানে কোরআনের আয়াত এবং হাদিস সমূহকে বিকৃত
অর্থ করে ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়। মুসলিম মাত্রই এই বিষয়ে স্বচ্ছ এবং পরিষ্কার
ধারণা থাকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ইনশাল্লাহ, নিম্নোক্ত
লেখাটির মাধ্যমে অনেকেরই জিহাদ বিষয়ক ভুল ধারণাটি ভেঙ্গে যাবে।
জিহাদ কি?
-------------------
“জিহাদ” আরবি শব্দ। এর অর্থ হল কঠোর পরিশ্রম করা, চেষ্টা
করা, সাধনা করা, সংগ্রাম করা। ইসলামী পরিভাষায় আল্লাহর
দ্বীনকে (ইসলামকে) বিজয়ী করার লক্ষে এবং একমাত্র আল্লাহকে খুশি করার জন্য কুফরী
তথা ইসলাম বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে মুমিনের সকল প্রচেষ্টা (দৈহিক, মানসিক, আর্থিক, জ্ঞানবুদ্ধি)
নিয়োজিত করাকে “জিহাদ” বলে। অন্য অর্থে স্বীয় নফসের বিরুদ্ধে, শয়তানের
বিরুদ্ধে, ফাসেকদের বিরুদ্ধে এবং মুশরিক-মুনাফিক-কাফেরদের বিরুদ্ধে
জান-মাল ও জবান দিয়ে লড়াই করাকে “জিহাদ” বলা
হয়।
জিহাদের প্রকারভেদ
-----------------------
জিহাদ
চার প্রকার:
১।
জিহাদের নফস: প্রবৃত্তির
বিরুদ্ধে জিহাদ।
জিহাদে
নফসের আবার চারটি স্তর রয়েছে:
প্রথম
স্তর: সত্য
কোথায় এবং সঠিক পথ কি তা খুঁজে বের কারা জন্য হৃদয়-মনকে অনুপ্রাণিত করা, অর্থাৎ হকের পরিচয় এবং হিদায়াত লাভের জন্য জ্ঞানের অনুশীলন এবং সাধনার
আশ্রয় গ্রহণ একান্ত প্রয়োজন। এ পথ কঠিন, এ পথ
বন্ধুর। মন সহজে এ দিকে আকৃষ্ট হয় না, মনকে এ কাজে
বাধ্য করার চেষ্টা করাই হচ্ছে জিহাদে নফসের প্রথম স্তর। এ স্তর অতিক্রম করতে না
পারলে দ্বীনের সৌভাগ্য অর্জনেই মানুষ বঞ্চিত হয় না, পার্থিব
সৌভাগ্য লাভও তার পক্ষে সম্ভব হয় না।
দ্বিতীয়
স্তর: সঠিক পথের পরিচয় লাভের পর সে পথে
চলার জন্য মনকে বাধ্য করা অর্থাৎ ‘ইলমের পর ‘আমলের জন্য মনকে বাধ্য করা। এ পথও অনেকের পক্ষে কঠিন। এজন্য প্রবৃত্তির
বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়। এ সংগ্রামই হচ্ছে জিহাদে নফসের দ্বিতীয় স্তর।
তৃতীয়
স্তর: নিজে সঠিক পথ চিনে সেই পথে চলার
সঙ্গে সঙ্গে অপরকেও সে পথ চেনাতে হবে এবং সে পথে চলার আহবান জানাতের হবে। এটা অতীব
গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য। যে সত্য সাধক এ কাজ সম্পাদনে অবহেলা প্রদর্শন করবে এবং এ
কর্তব্য পালনে উদাসীনতা দেখাবে সে সেসব কমবখত- দুর্ভাগাদের অন্তর্ভুক্ত হবে যারা
সত্যকে গোপন করে থাকে। এর নাম তালিম ও দাওয়াত- সত্য শিক্ষাদান এবং সত্যপথে আহবান।
এ কাজও কঠিন, এ কাজে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, অনেক পরিশ্রম করতে হয়। এ ত্যাগ স্বীকার এবং পরিশ্রমের জন্য মনকে
প্রস্তুত করা জিহাদে নফসের তৃতীয় স্তর।
চতুর্থ
এবং শেষ স্তর: মানুষকে সত্যপথে আহবান জানাতে এবং
তাদের সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখতে গিয়ে অনেক বিপদাপদের সম্মুখীন হতে হয়, অনেক দুঃখ-কষ্ট ও মুসিবতে পরতে হতে হয়, বহু
পরীক্ষায় নিপতিত হতে হয়। সে অবস্থায় বিপদ ও ও মুসিবতে ধৈর্য ধারণ করতে হয়, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। শুধু তাই নয়, দুঃখ-কষ্টে
ধৈর্যের তাওফিক লাভ এবং হৃদয়ের দৃঢ়তা আর সংকল্পের অটলতার জন্য আল্লাহর শুকরিয়াও
জানাতে হয়। হৃদয়-মন-দেহকে এরূপ দৃঢ় করে গড়ে তোলার এবং বর্ণিত অবস্থাতেও আল্লাহর
প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের জন্য মানস প্রবণতা সৃষ্টি জিহাদে নফসের চতুর্থ এবং শেষ
স্তর। যে ব্যক্তি জিহাদে নফসের এ চারটি স্তরই সাফল্যের সঙ্গে অতিক্রম করতে সক্ষম, সেই প্রকৃত ভাগ্যবান, কারণ তখন সে
আল্লাহর প্রতি নিবেদিত-প্রাণ সত্যিকারের অনুসারী।
২।
জিহাদে শয়তান: শয়তানের
বিরুদ্ধে জিহাদ।
জিহাদে
শয়তান
শয়তানের
সাথে জিহাদের দুইটি পর্যায়। শয়তান মানুষের ঈমানের উপর সন্দেহ এবং
দ্বিধা-দ্বন্দ্বের বীজ বুনে দেয়। এ ব্যাপারে তাকে মোটেই আমল না দেয়াই হচ্ছে জিহাদে
শয়তানের প্রথম পর্যায়। আর দ্বিতীয় পর্যায় হচ্ছে শয়তানের তরফ থেকে যেসব অনভিপ্রেত
ইচ্ছা এবং গর্হিত বাসনা মনের ভিতর নিক্ষেপ করা হয় এবং যার প্রতি হৃদয়ের কোণে অনুরাগ
সৃষ্টি হয় তা প্রতিহত ও দূরীভূত করার জন্য যুদ্ধ-জিহাদ-সাধনা ও সংগ্রাম চালিয়ে
যাওয়া। প্রথম পর্যায়ের জিহাদে সাফল্য লাভে হৃদয়ে সৃষ্টি হয় ইয়াকীন বা প্রত্যয়। আর
দ্বিতীয় পর্যায়ের সাফল্যে মনে দৃঢ়মূল হয় সবর তথা অটল ধৈর্য।
এ
প্রত্যয়-দৃঢ় ধৈর্যশীল ব্যক্তিগণই সমাজ ও জাতির নেতৃত্ব করার অধিকার লাভ তথা মানব
সমাজতে হিদায়েতের পথে পরিচালনার যোগ্যতা অর্জন করে থাকে।
আল্লাহ
রাব্বুল আলামীন বলেন:
“আমি তাদের মধ্য থেকে ইমাম বা নেতা বানিয়ে দিয়েছি সে সব লোককে যারা
(লোকদের ) সঠিক পথে পরিচালনা করে থাকে আমারই হুকুম মুতাবেক; তারা এ যোগ্যতা অর্জনে সক্ষম হয় তাদের ধৈর্য ও দৃঢ়তার গুণে এবং আমার
নিদর্শনসমূহের প্রতি অটল আস্থার কল্যাণে”। (সূরা আস-সাজদাহ ৩২:২৪)
এথেকে এ
কথা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, নেতৃত্ব ও
কর্তৃত্ব কেবলমাত্র সবর ও ইয়াকীন- ধৈর্য ও দৃঢ়তা এবং আল্লাহর প্রতি প্রত্যয় ও
নির্ভরতার কল্যাণেই অর্জিত হয়ে থাকে। ‘সবর’ বা ধৈর্য হৃদয়ের অশুভ বাসনা এবং গর্হিত কামনাকে প্রতিরোধ করে আর ‘ইয়াকীন’ বা প্রত্যয় শোবা-সন্দেহ, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থেকে হৃদয়-মনকে পাক-পবিত্র ও নিষ্কলুষ করে তোলে।
এখানে এ
কথা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, নেতৃত্ব ও
কর্তৃত্ব কেবলমাত্র সবর ও ইয়াকীন- ধৈর্য ও দৃঢ়তা এবং আল্লাহর প্রতি প্রত্যয় ও
নির্ভরতার কল্যাণেই অর্জিত হয়ে থাকে। ‘সবর’ বা ধৈর্য হৃদয়ের অশুভ বাসনা এবং গর্হিত কামনাকে প্রতিরোধ করে আর ‘ইয়াকীন’ বা প্রত্যয় শোবা-সন্দেহ, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থেকে হৃদয়-মনকে পাক-পবিত্র ও নিষ্কলুষ করে তোলে।
৩।
জিহাদে কুফফারঃ কাফিরের
বিরুদ্ধে জিহাদ।
৪।
জিহাদে মুনাফিকীনঃ মুনাফিকদের
বিরুদ্ধে জিহাদ।
জিহাদে
মুনাফিকীন ও জিহাদে কুফফার
মুনাফিক
তথা কপট শ্রেণী এবং কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদের স্তর চারটি। এর প্রথম স্তরে অন্তর
দিয়ে, দ্বিতীয় স্তরে জবান দিয়ে, কথার মাধ্যমে, উপদেশ দিয়ে, নসিহত করে বা তিরস্কার করে, তৃতীয় স্তরে
অর্থ ব্যয় করে এবং চতুর্থ স্তরে জান ও প্রাণ দিয়ে অর্থাৎ প্রকাশ্যে সংগ্রামে
অবতীর্ণ হয়ে জিহাদ করতে হয়। হাদিসে বলা হয়েছে,
“যে ব্যক্তি জিহাদ না করে, কমপক্ষে
জিহাদের বাসনা হৃদয়ে পোষণ না করে মৃত্যুবরণ করে তার মরণ হবে আংশিক কপটের মৃত্যু।”
জিহাদ হিজরতের দ্বারা পরিপূর্ণতা লাভ করে আর হিজরত এবং জিহাদের সমবায়ে
ঈমান হয়ে উঠে বিশুদ্ধতর, পূর্ণতর।
জিহাদকে
কেন বৈধতা দেয়া হল?
-----------------------------------
জিহাদ ও
যুদ্ধের পার্থক্য: যুদ্ধ আসলে ভালো কাজ নয়; যুদ্ধ-বিগ্রহ
দাংগা-হাংগামা মানুষের জন্য কোন কল্যাণ বয়ে আনে না। তবে, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে এটার দ্বারস্থ হতে হয়। যখন যুদ্ধ ছাড়া
সমাজকে শান্তিপূর্ণ রাখার আর কোন পথ অবশিষ্ট থাকেনা তখনই বাধ্য হয়ে জিহাদের
চূড়ান্ত স্তর যুদ্ধের মত কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়। ঠিক তেমনি আল্লাহ
তায়ালা জিহাদকে পবিত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে শান্তি ও স্থিতিশীলতা
রক্ষার সর্বশেষ চেষ্টা হিসেবে বৈধ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
• আর এ কাফেরদের সাথে এমন যুদ্ধ করো যেন গোমরাহী ও বিশৃঙ্খলা নির্মূল
হয়ে যায় এবং দ্বীন পুরোপুরি আল্লাহ তায়ালার জন্য নির্দিষ্ট হয়ে যায়। তারপর যদি
তারা ফিতনা থেকে বিরত হয় তাহলে আল্লাহই তাদের কার্যকলাপ দেখবেন। (সুরা আনফাল: ৩৯)
অন্যত্র
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
• তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকো যতক্ষণ না ফিতনা নির্মূল হয়ে যায় এবং
দীন একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট হয়ে যায়। তারপর যদি তারা বিরত হয় তাহলে জেনে
রাখ জালেম তথা অত্যাচারী ছাড়া আর করোর ওপর হস্তক্ষেপ করা বৈধ নয়। (সুরা বাকারা:
১৯৩)
জিহাদ
কখন ফরজ তথা আবশ্যক হয়?
----------------------
অধিকাংশ
ইসলামিক স্কলারের মতে নিম্নের কয়েকটি অবস্থায় জিহাদ ফরজ হয়।
প্রথমত: যখন দু’টি দল (মুসলিম ও
অমুসলিম) পরস্পর মুখোমুখি হয়। যুদ্ধ ছাড়া আর কোন শান্তিপূর্ণ পথ খোলা থাকে না তখন
উপস্থিত ব্যক্তিদের সেখান থেকে পলায়ন করা বৈধ নয়। তখন উপস্থিত প্রত্যেক ব্যক্তির
জন্য আবশ্যক হয়ে যায় দৃঢ়পদ ও অবিচল থাকা। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
• হে ঈমানদারগণ! যখন কোন দলের সাথে তোমাদের মোকাবিলা হয়,তোমরা দৃঢ়পদ থাকো এবং আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকো বেশী বেশী করে। আশা
করা যায়,এতে তোমরা সাফল্য অর্জন করতে পারবে। আর আল্লাহ ও
তাঁর রসূলের আনুগত্য করো এবং নিজেদের মধ্যে বিবাদ করো না,অন্যথায় তোমাদের মধ্যে দুর্বলতা দেখা দেবে এবং তোমাদের প্রতিপত্তি
নিঃশেষ হয়ে যাবে। অতএব, তোমরা ধৈর্যধারণের পন্থা
অবলম্বন কর,নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।
(সুরা আনফাল: ৪৫-৪৬)
দ্বিতীয়ত: যখন শত্রুবাহিনী কোন মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর আকস্মিক আক্রমণ করে তখন
নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলের উপর আবশ্যক হয়ে যাবে তাদের গতিরোধ করা। তারা যদি
সক্ষম না হয় তাহলে, তাদের পার্শ্ববর্তী লোকদের উপর
পর্যায়ক্রমে জিহাদ ফরজ হবে।
তৃতীয়ত:
রাষ্ট্রপ্রধান যখন কোন সম্প্রদায়কে জিহাদে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেন তখন জিহাদে
যাওয়া আবশ্যক হবে। তবে, কারও কোন ওজর থাকলে ভিন্ন কথা।
আল্লাহ
তায়ালা বলেন:
• হে ঈমানদারগণ! তোমাদের কি হলো,যখনই তোমাদের
আল্লাহর পথে জিহাদে বের হতে বলা হয়, তখনি তোমরা
মাটি কামড়ে পড়ে থাক?তোমরা কি আখেরাতের মোকাবিলায়
দুনিয়ার জীবনকে বেশী পছন্দ করে নিয়েছ?যদি তাই হয় তাহলে
তোমরা মনে রেখ,দুনিয়ার জীবনের এমন সাজ সরঞ্জাম আখেরাতে
খুবই সামান্য বলে প্রমাণিত হবে। তোমরা যদি না বের হও তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে
যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দেবেন এবং তোমাদের জায়গায় আরেকটি দলকে নিয়ে আসবেন,তখন তোমরা আল্লাহ তায়ালার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তিনি সব বিষয়ের
ওপর ক্ষমতাবান। (সুরা তাওবা: ৩৮-৩৯)