অপ্রিয় সত্য
সিকিমের স্বাধীনতা গ্রাসের ভারতীয় পদ্ধতি।
বর্তমান প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ। সহায়ক শক্তিটিকে আপনারা একটু মাথা খাটালেই চিনতে
পারবেন। আর এবারের লেন্দুপ দর্জ ‘র ভূমিকায়, আমাদের দেশের
প্রভাবশালী এক পরিবার। চলুন এক নি:শ্বাসে পড়ে ফেলি আলম মাসুমের প্রবন্ধ- “সিকিমের স্বাধীনতার সূর্যাস্ত ও একজন লেন্দুপ দর্জি” ৬ এপ্রিল ১৯৭৫ সাল। সিকিমের সকালটা ছিল অন্য রকম। পাঁচ হাজার ভারতীয়
সৈন্য নিয়ে মিলিটারি কনভয় ঢুকে পড়ে রাজধানী গ্যাংটকে। রোদেলা দিনের শুরুতে এই
পাহাড়ি শহরে সে দিনও ফুটেছিল রডোডেনড্রনসহ নানা বর্ণের ফুল। রাজা পালডেন ও সিকিম
বাসীর জন্য সেটাই ছিল স্বাধীন রাজ্যের শেষ দিবস। এটা তারা বুঝতে পারেন যখন ভারতীয়
সৈন্যরা প্রকাশ্য দিবালোকে রাজপ্রাসাদ ঘেরাও করে মেশিনগান দিয়ে মুহুর্মুহু
গুলিবর্ষণ শুরু করে। তারপর সিকিমের পতাকা নামিয়ে তিন রঙা ভারতীয় জাতীয় পতাকা
উত্তোলন। কংগ্রেস নেত্রী ইন্দিরা গান্ধী তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। সিকিমকে ভারতের
অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতা লেন্দুপ দর্জি
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তবে মাতৃভূমির স্বাধীনতা ভারতের হাতে তুলে দেয়ার
জন্য তিনি এক অভিশপ্ত জীবন বয়ে বেড়িয়েছেন। সিকিমে তার ঠাঁই হয়নি। রাজনীতি থেকে
তাকে বিদায় করা হয়। শেষজীবন কাটে প্রতিবেশী দার্জিলিংয়ের (পশ্চিমবঙ্গ) কালিমপাং
শহরে। একাকী, নিঃসঙ্গ, নিন্দিত ও
ভীত সন্ত্রস্ত এক জীবনযাপন শেষে লেন্দুপ দর্জি নীরবে মৃত্যুবরণ করেন। নাটের গুরুরা
পেছন থেকে সব কলকাঠি নাড়েন। নিজের দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকদের নাম কখনো হয় মীরজাফর,
কখনো লেন্দুপ দর্জি, কখনো বা অন্য কিছু।
দেশ ও কালের তফাৎ হয় কিন্তু ইতিহাসের অনিবার্য শাস্তি এদের পেতেই হয়। সিকিম ভারতের
দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম রাজ্য। আয়তন ৭,০৯৬ বর্গ কিলোমিটার।
২০১১ সালের গণনা অনুযায়ী লোকসংখ্যা ৬,০৭,০০০ জন। সিকিমের ভূ-কৌশলগত অবস্থান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এ রাজ্যের উত্তরে চীন, পশ্চিমে নেপাল,
পূর্বে ভুটান ও দক্ষিণে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং। সিকিম- তিব্বত
(চীন) বাণিজ্যপথ ‘না থুলা পাস’ আন্তর্জাতিক
গুরুত্ব বহন করে। সামরিক গুরুত্বপূর্ণ শিলিগুড়ি করিডোর সিকিমের কাছেই। বাংলাদেশের
উত্তর-পশ্চিম দিকে সিকিমের অবস্থান। ঢাকা থেকে সড়ক পথে রাজধানী গ্যাংটকের দূরত্ব
৬৫৪ কিলোমিটার। লেন্দুপ দর্জি ও সিকিম ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের বিদায়ের পর মনিপুর,
ত্রিপুরা, কুচবিহারসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চ
লীয় রাজ্যগুলো ভারতীয় ইউনিয়নে যোগদান করে অথবা যোগদানে বাধ্য করা হয়। সিকিম
রাজ্যেও তার ঢেউ লাগে। নয়াদিল্লীর পরামর্শে গঠিত হয় সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস
(এসএনসি)। আত্মপ্রকাশের পরই এসএনসি সিকিমে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সংগঠিত
করতে থাকে। সিকিমের রাজা (চগিয়াল) পালজেন থনডাপ নামগিয়াল বিক্ষোভ সামাল দিতে
প্রাথমিকভাবে সমর্থ হন। লেন্দুপ দর্জির নেতৃত্বে আন্দোলন জওয়াহের লাল নেহরুর
মৃত্যুর পর লালবাহাদুর শাস্ত্রী স্বল্পকালের (১৯৬৪-৬৬) জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী
হন। শাস্ত্রীর আকস্মিক মৃত্যুর পর ১৯৬৬ সালে ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী
নিযুক্ত হন। এরপর থেকে সিকিমে যে রাজনৈতিক সঙ্কট শুরু হয়, সেখান থেকে এই হিমালয়ান রাজ্যটি আর বেরিয়ে আসতে পারেনি। ১৯৭৩ সালে
এসএনসি লেন্দুপ দর্জির নেতৃত্বে চগিয়ালবিরোধী আন্দোলন শুরু করে, যা শেষ পর্যন্ত এই সার্বভৌম রাজ্যের ভারতে বিলীন হওয়ার মধ্য দিয়ে শেষ
হয়। ভারতীয়রা সাদা পোশাকে সিকিমে ঢুকে বিক্ষোভে যোগ দিত সিকিমের বৌদ্ধ রাজার
বিরুদ্ধে পরিচালিত এসএনসির আন্দোলনকে ভারত খোলাখুলি সমর্থন জানায়।
চগিয়ালের তৎকালীন এডিসি ক্যাপ্টেন সোনাম
ইয়াংদা দাবি করেন, ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা সাদা পোশাকে সিকিমে ঢুকে এসব বিক্ষোভে অংশ
নিত। দার্জিলিংসহ আশপাশের ভারতীয় এলাকা থেকে লোক এনে বিক্ষোভ সংগঠিত করা হতো। এসব
আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী স্থানীয় সিকিমিদের সংখ্যা ছিল খুব কম। লেন্দুপ দর্জিকে
ভারতের আর্থিক সহায়তা ক্যাপ্টেন সোনামের ভাষ্য অনুযায়ী লেন্দুপ দর্জির আন্দোলনে
ভারত আর্থিক সহযোগিতাও প্রদান করত। দর্জি স্বীকার করেছেন, ভারতীয় ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি) কর্মকর্তারা বছরে দুই থেকে তিনবার
তার সাথে সাক্ষাৎ করতেন। আইবি এজেন্ট তেজপাল সেন ব্যক্তিগতভাবে দর্জির কাছে টাকা
হস্তান্তর করতেন। মুখ্য ভূমিকায় ‘র’ ‘মিশন সিকিম’ এর পেছনে মুখ্য ভূমিকায় ছিল
ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ (RAW)। ১৯৬৮ সালে আত্মপ্রকাশের তিন বছরের মাথায়
১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে ‘র’ সাফল্য পায়। সিকিমের
ভারতে অন্তর্ভুক্তি ‘র’ এর একটি
ঐতিহাসিক সাফল্য। ‘র’ দু’বছর সময় নেয় সিকিমে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির জন্য ভুটান ১৯৬৮ সালে
জাতিসঙ্ঘের সদস্যপদ লাভের মাধ্যমে নিজেদের পৃথক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সমর্থ হয়।
সিকিমের ব্যাপারে ‘র’ এর
কুশীলবরা তাই আগাম সতর্ক পদক্ষেপ নিতে ভুল করেননি। এ সম্পর্কে অশোক রায়না তার
গ্রন্থ RAW : The Story of India's Secret Service এ
লিখেছেন নয়াদিল্লী ১৯৭১ সালেই সিকিম দখল করতে চেয়েছিল। ‘র’
দুই বছর সময় নেয় সিকিমে একটি উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির জন্য। এ
ক্ষেত্রে নেপালি বংশোদ্ভূত হিন্দু ধর্মাবলম্বী সিকিমি নাগরিকদের ক্ষোভকে ব্যবহার
করা হয়। তাদের দীর্ঘ দিনের অভিযোগ ছিল, সিকিমের বৌদ্ধ
রাজা স্থানীয় নেপালি হিন্দু প্রজাদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করছেন।
গ্যাংটক টাইমস পত্রিকার সম্পাদক ও সাবেক
মন্ত্রী সিডি রাই এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম, সিকিম
রাজার বৈষম্যমূলক শাসনের চাইতে ভারতীয় নাগরিক হওয়া ভালো।’ ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের জন্য নয়াদিল্লীর চাপ কাজী পরিবারের সন্তান লেন্দুপ
দর্জির সাথে সিকিমের রাজপরিবারের দ্বন্দ্ব ছিল বহু দিনের পুরনো। দর্জি অভিযোগ
করেছেন, ‘আমি চেয়েছিলাম, গণবিক্ষোভের
মাধ্যমে চগিয়ালের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে। কিন্তু রাজা কখনোই তা কর্ণপাত করেননি।
নয়াদিল্লী থেকে সিকিমের রাজাকে বারবার চাপ দেয়া হয় ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের জন্য। এই
তিনপক্ষ হচ্ছে : সিকিম রাজ, এসএনসি ও ভারত। চাপের মুখে
রাজা বৈঠকে বসতে বাধ্য হন। এ ধরনের বৈঠক সিকিমের রাজার সার্বভৌম ক্ষমতাকে খর্ব
করে। সিকিম কার্যত ভারতের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয়। এসএনসির সরকার গঠন রাজতন্ত্র
বিলোপের সিদ্ধান্ত এই প্রেক্ষাপটে ১৯৭৪ সালে সিকিমে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
লেন্দুপ দর্জির এসএনসি নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে। সরকার গঠন করে।
রাজতন্ত্র তখনো বহাল কিন্তু রাজা ও সরকার পরস্পরকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করে।
রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ একটি পরিণতির দিকে এগোতে থাকে। ১৯৭৫ সালের ২৭ মার্চ লেন্দুপ
দর্জির নেতৃত্বে মন্ত্রীসভার বৈঠকে সিকিমের রাজতন্ত্র বিলোপের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
পার্লামেন্ট এই সিদ্ধান্ত অনুমোদন করে। রাজতন্ত্রের ভাগ্য নির্ধারণের জন্য গণভোটের
সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। চার দিন পর ৫৭টি কেন্দ্রে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। কারচুপির গণভোট :
রাজতন্ত্র বিলুপ্ত সিকিমের তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী কে সি প্রধান গণভোটের স্মৃতিচারণ
করে বলেন, ‘গণভোট ছিল একটা বাধা মাত্র। ভারতীয় সৈন্যরা
ভোটারদের দিকে বন্দুক উঁচিয়ে নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি করে। গণভোটের ফলাফল দাঁড়ায়
সিকিমে রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি।
এরপর প্রধানমন্ত্রী লেন্দুপ দর্জি
পার্লামেন্টে সিকিমের ভারতে যোগদানের প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করেন।
সিকিমের পার্লামেন্টে ভারতে যোগদানের প্রস্তাব পাস সিকিমের ৩২ আসনের পার্লামেন্টে
৩১ জনই ছিল লেন্দুপ দর্জির এসএনসির সদস্য। প্রস্তাবটি সংসদে বিনা বাধায় পাস হয়।
সিকিমে কর্মরত তৎকালীন ভারতীয় দূত (পলিটিকাল অফিসার) বিএস দাস তার গ্রন্থ 'The Sikkim Saga' এ
লিখেছেন, ‘ভারতের জাতীয় স্বার্থেই সিকিমের অন্তর্ভুক্তি
প্রয়োজন ছিল। আমরা সে লক্ষ্যেই কাজ করেছি। চগিয়াল যদি বিচক্ষণ হতেন এবং তার
কার্ডগুলো ভালোভাবে খেলতে পারতেন, তাহলে ঘটনা যেভাবে
ঘটেছে তা না হয়ে ভিন্ন কিছু হতে পারতো।’ চীন, নেপাল ও পাকিস্তানের পরামর্শে কান দেননি সিকিমের চগিয়াল ১৯৭৪ সালে যখন
সিকিমে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা চগিয়াল তখন কাঠমান্ডু গিয়েছিলেন নেপালের রাজা
বীরেন্দ্রর অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে রাজা
বীরেন্দ্র, সফররত চীনা উপপ্রধানমন্ত্রী চেন লাই ইয়ান এবং
পাকিস্তানি দূত চগিয়ালকে সিকিমে না ফিরতে পরামর্শ দেন। ক্যাপ্টেন সোনাম এ প্রসঙ্গে
বলেন, এই তিন দেশের নেতৃবৃন্দ সিকিমকে ভারতীয় আগ্রাসন
থেকে বাঁচাতে একটি মাস্টার প্ল্যান উপস্থাপন করেন। কিন্তু চগিয়াল লামদেন তাতে
সম্মতি দেননি। এর কারণ তিনি নাকি স্বপ্নেও ভাবেননি, ভারত
সিকিম দখল করে নিতে পারে। ভারতের দ্বৈত ভূমিকা ভারত এ ক্ষেত্রে দ্বৈত খেলা খেলেছে।
এক দিকে চগিয়াল লামডেনকে বলেছে সিকিমে রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হবে। অপর দিকে
লেন্দুপ দর্জিকে বলেছে যেকোনো মূল্যে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করতে হবে।
চগিয়ালকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অনারারি মেজর
জেনারেল পদবিও প্রদান করা হয়েছিল। সিকিম দখল ভারতীয় সেনাদের মুহুর্মুহু গুলি :
রাজপ্রাসাদের প্রহরী বসন্তকুমার ছেত্রি নিহত হন। প্রকাশ্য দিবালোকে সামরিক ট্রাকের
গর্জন শুনেব সিকিমের চগিয়াল দৌড়ে এসে দাঁড়ান জানালার পাশে। ভারতীয় সৈন্যরা রাজপ্রাসাদ
ঘিরে ফেলে। মেশিনগানের মুহুর্মুহু গুলিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। রাজপ্রাসাদের ১৯ বছর
বয়সী প্রহরী বসন্ত কুমার ছেত্রি ভারতীয় সেনাদের গুলিতে নিহত হন। আধা ঘণ্টার
অপারেশনেই ২৪৩ প্রহরী আত্মসমর্পণ করে। বেলা পৌনে ১টার মধ্যেই অপারেশন সিকিম সমাপ্ত
হয়। প্রহরীদের কাছে যে অস্ত্র ছিল তা দিয়ে ভারতীয় সৈন্যদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু সময়
লড়াই করা যেত। কিন্তু রাজা ভুগছিলেন সিদ্ধান্তহীনতায়। তিনি আরেকটি সুযোগ হারালেন।
রাজপ্রসাদে ট্রান্সমিটার বসানো ছিল, যাতে বেইজিং ও ইসলামাবাদের কাছে তিনি জরুরি
সাহায্য চাইতে পারেন। সে ক্ষেত্রে চীনা সৈন্যরা প্রয়োজনে সিকিমে ঢুকে চগিয়াল
লামডেনকে উদ্ধার করতে পারত। কিন্তু রাজা সেটাও করতে ব্যর্থ হন। প্রহরীরা তখনো
গাইছিল ‘আমার প্রিয় মাতৃভূমি ফুলের মতো ফুটে থাকুক’
আত্মসমর্পণকারী রাজপ্রহরীদের ভারতীয় সেনাদের ট্রাকে তোলা হয়।
প্রহরীরা তখনো গাইছিল ‘ডেলা সিল লাই গি, গ্যাং চাংকা সিবো’ (আমার প্রিয় মাতৃভূমি ফুলের
মতো ফুটে থাকুক)। কিন্তু ততক্ষণে সিকিমের রাজপ্রাসাদে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে তিনরঙা
ভারতীয় জাতীয় পতাকা। নামগিয়াল সাম্রাজ্যের ১২তম রাজা চগিয়াল লামডেন তখন প্রাসাদে
বন্দী। চগিয়াল ভারতীয় নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে করম চাঁদ গান্ধী ও জওহর লাল নেহরুর
প্রতি ছিলেন খুবই শ্রদ্ধাশীল। বন্দুক দিয়ে মাছি মারা ১৯৬০ সালে নেহরু ভারতীয়
সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারকে বলেছিলেন, সিকিমের মতো একটি ছোট
দেশকে জোর করে অধিকার করা হবে বন্দুক দিয়ে মাছি মারার মতো ঘটনা। কিন্তু এটাই সত্য
যে, নেহরুর কন্যা ইন্দিরা গান্ধী সিকিম দখলের মধ্যে ‘জাতীয় স্বার্থ’ খুঁজে পেয়েছিলেন।
দুই বিদেশিনী সিকিমের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী
বি বি গুরুং একবার বলেছিলেন, চগিয়াল লামডেন ও লেন্দুপ দর্জি মূলত একটি প্রক্সি
যুদ্ধ করেছেন। প্রকৃত যুদ্ধ ছিল এক আমেরিকান ললনার সাথে এক বেলজিয়াম ললনার। কিন্তু
যুদ্ধে জয়ী হলেন এক তৃতীয় নারী। তিনি হলেন ইন্দিরা গান্ধী। হোপ কুক সিকিম রাজা
চগিয়াল পালডেন ১৯৬৩ সালে আমেরিকান কন্যা হোপ কুকের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
তাদের পরিচয় হয়েছিল দার্জিলিংয়ে। সিকিমের রানী হওয়া কুকের জন্য ছিল এক বিরাট
স্বপ্নপূরণ। বিশৃঙ্খল রাজনৈতিক পরিবেশ তিনি সিকিমের স্বাধীনতা রক্ষার বানী
যুবসমাজের মধ্যে প্রচার করতে থাকেন। আন্তর্জাতিক স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে
নয়াদিল্লী হোপ কুকের তৎপরতার পেছনে সিআইএর হাত আছে বলে সন্দেহ করে তাকে সিআইএর
এজেন্ট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মার্কিন কন্যার সাথে নয়াদিল্লীর সম্পর্কের অবনতি
ঘটতে থাকে। চগিয়াল পালডেনের সাথেও তার দাম্পত্য সম্পর্কে ফাটল ধরে। ১৯৭৩ সালে হোপ
কুক তার দুই সন্তানকে নিয়ে নিউ ইয়র্কে চলে যান। তিনি আর কখনোই সিকিমে ফিরে আসেননি।
এলিসা মারিয়া : ১৯৫৭ সালে কাজী লেন্দুপ দর্জি বিয়ে করেন এলিসা মারিয়াকে। তাদের
পরিচয় হয় নয়াদিল্লীতে। এলিসার পিতা একজন বেলজীয় ও মা জার্মান। এলিসা তার স্কটিশ
স্বামীকে ত্যাগ করে বার্মা থেকে নয়াদিল্লীতে চলে এসেছিলেন। সিকিমের রাজনৈতিক
পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে এলিসা মারিয়া ও হোপ কুক মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে যান।
এলিসা চাচ্ছিলেন সিকিমের মুখ্যমন্ত্রীর স্ত্রী হিসেবে ফার্স্ট লেডি হতে। অপর দিকে
হোপ কুক চেয়েছিলেন স্বাধীন সিকিমের রানী হতে। কিন্তু বাস্তবে যা ঘটেছে, তা দুই বিদেশিনীর প্রত্যাশার বিপরীত।
কালিমপঙে নির্জনবাস গণরোষ আতঙ্ক শেষ জীবনে
নানা রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পান লেন্দুপ দর্জি। তা সত্ত্বেও স্ত্রী এলিসাকে নিয়ে
সিকিম ছেড়ে দার্জিলিংয়ের কালিমপং শহরে নির্জনবাসে চলে যেতে বাধ্য হন। তারা তাদের
অতীত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য অনুতপ্ত জীবনযাপন করতে থাকেন। এলিসা ১৯৯০ সালে
পরলোক গমন করেন। এরপর থেকে লেন্দুপ দর্জি একা জীবনযাপন করতে বাধ্য হন। তাদের কোনো
সন্তান- সন্ততি ছিল না। আত্মীয়স্বজনও তাকে দেখতে যেত না। গণরোষ ও মানুষের ঘৃণা
থেকে বাঁচতে লেন্দুপ দর্জি নিজেকে সবার কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতেন। চীন
সীমান্তে ৩ স্বাধীন রাষ্ট্র নয়াদিল্লীর জন্য অস্বস্তিকর ছিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের
অভ্যুদয় ও ১৯৭৪ সালে ভারতের পারমাণবিক বোমার সফল বিস্ফোরণ ইন্দিরা গান্ধীর
আত্মবিশ্বাস বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। কংগ্রেস নেত্রী নয়াদিল্লীতে তার ক্ষমতাকে সুসংহত
করেন। পূর্বাঞ্চলীয় ক্ষুদ্র রাজ্য সিকিমের ওপর তার নজর পড়ে। নয়াদিল্লী উদ্বিগ্ন
ছিল সিকিমের স্বাধীন সত্তার বিকাশ নিয়ে। ভুটানের পথ ধরে সিকিম যদি স্বাধীন রাষ্ট্র
হিসেবে জাতিসঙ্ঘের সদস্যপদ লাভ করে ফেলত, তাহলে তা হতো নয়াদিল্লীর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের
পথে বড় রকম বাধা। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে চীন সীমান্তে তিন হিমালয়ান স্বাধীন রাজ্য
নেপাল, সিকিম ও ভুটান গায়ে গা লাগিয়ে অবস্থান করুক এটাও
কৌশলগত কারণে দিল্লি নিরাপদ মনে করেনি। মোরারজি দেশাইয়ের মতে সিকিমের ভারতে
অন্তর্ভুক্তি ছিল ভুল সিদ্ধান্ত ১৯৭৫ ভারতের সিকিম দখলের বিরুদ্ধে চীন গভীর উদ্বেগ
প্রকাশ করে। ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সিকিমের রাজপথে কোনো গণপ্রতিরোধ দেখা
যায়নি। তাই জাতিসঙ্ঘে প্রতিক্রিয়া জানানোর মধ্যেই বেইজিংয়ের ভূমিকা সীমিত থাকে।
১৯৭৭ সালে ভারতে ইন্দিরা গান্ধীর টানা ১১
বছরের শাসনের অবসান ঘটে। ১৯৭৮ সালে প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই সিকিম সম্পর্কে
মুখ খোলেন। তার মতে, সিকিমের ভারতে অন্তর্ভুক্তি ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। এমনকি সিকিমের যেসব
রাজনৈতিক নেতা ভারতে যোগদানের পক্ষে কাজ করেছিলেন, তারাও
বলেছেন এটা ছিল ঐতিহাসিক ভুল। কিন্তু তত দিনে তিস্তা নদী দিয়ে অনেক পানি গড়িয়ে
ভাটিতে নেমে এসেছে। লেন্দুপ দর্জি হলেন প্রথম মুখ্যমন্ত্রী: ৪ বছর পর ভোটার
তালিকায় তার নাম নেই ১৯৭৫ সালে ভারতে যোগদানের পর লেন্দুপ দর্জি হন সিকিমের প্রথম
মুখ্যমন্ত্রী। ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে আসীন ছিলেন। রাজনৈতিক হাওয়া উল্টা
দিকে বইতে থাকে। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে এ লেন্দুপ দর্জির এসএনসি একটি আসনও পায়নি।
নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়ে লেন্দুপ দর্জি দেখেন ভোটার তালিকায় তার নামটিও
নেই। নেপথ্য শক্তি তার রাজনৈতিক জীবনের পরিসমাপ্তি টেনে দেয়। নিঃসঙ্গ, অপমানিত অবস্থায় সিকিমের বাইরে লেন্দুপ দর্জির মৃত্যুবরণ নামগিয়াল
রাজবংশের শাসনের অবসান করতে গিয়ে এভাবেই লেন্দুপ দর্জি ৪০০ বছরের ইতিহাসসমৃদ্ধ
স্বাধীন মাতৃভূমিকে ভারতের হাতে তুলে দেন। বিনিময়ে লাভ করেন অতীত কর্মকাণ্ড
সম্পর্কে সর্বদা ভীতসন্ত্রস্ত এক অপমানজনক জীবন। ২০০৭ সালের ২৮ জুলাই নিঃসঙ্গ
অবস্থায় কলিমপংয়ে তিনি পরলোকগমন করেন। তখন তার বয়স ১০৩ বছর। এর আগে ২০০২ সালে ভারত
সরকার তাকে ‘পদ্মভূষণ’ ও রাজ্য
সরকার ২০০৪ সালে তাকে ‘সিকিম রত্ন’ উপাধিতে ভূষিত করে।
মাতৃভূমির সাথে লেন্দুপ দর্জির বিশ্বাসঘাতকতা
সমকালীন ইতিহাসে সমালোচকদের কাছে লেন্দুপ দর্জি একজন বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত।
তার সমর্থকেরাও পরবর্তী সময়ে তাকে ত্যাগ করেন। ১৯৯৬ সালে কালিমপংয়ে স্বেচ্ছা
নির্বাসিত জীবন লেন্দুপ দর্জি দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘সবাই আমার দিকে অভিযোগের
আঙুল তুলে বলছে, আমি নাকি নিজের মাতৃভূমি সিকিমকে বিক্রি
করে দিয়েছি। তা যদি সত্যও হয় সে জন্য কি আমি একাই দায়ী?’ কিন্তু
এই অভিযোগ এতই গুরুতর ছিল যে, লেন্দুপ দর্জি আর কখনোই
সিকিমে সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরে যেতে পারেননি। চাকুং হাউজে আমৃত্যু তাকে নিঃসঙ্গ
দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে হয়। তার মৃত্যু সিকিমবাসীর মনেও কোনো সহানুভূতি বা বেদনার
উদ্রেক করতে পারেনি। কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর দিল্লি আমাকে ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করে
লেন্দুপ দর্জি মনে করতেন উদ্দেশ্য হাসিলের পর নয়াদিল্লী তাকে অবশ্যই ছুড়ে ফেলে
দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে তার আক্ষেপভরা মন্তব্য, ‘সিকিমকে ভারতের
হাতে তুলে দিতে হেন চেষ্টা নেই যা আমি করিনি। কিন্তু কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর
নয়াদিল্লি আমাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে। সাপ্তাহিক জন আস্থা পত্রিকায় সাক্ষাৎকার
দিয়ে লেন্দুপ দর্জি বলেন, ‘আগে নয়াদিল্লীতে আমাকে লাল
গালিচা সংবর্ধনা দিয়ে বরণ করা হতো। এখন ভারতের দ্বিতীয় সারির নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ
করতেও আমাকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়। ২০০০ সালে অপর এক সাক্ষাৎকারে
লেন্দুপ দর্জি বলেন, প্রধানমন্ত্রী জওয়াহের লাল নেহরু ও
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নয়াদিল্লীতে এক সময় আমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাতেন।
কিন্তু রাজনৈতিক মঞ্চে কাজ শেষ হলে আমাকে ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করা হয়। (শেষ) নেপাল
ম্যাগাজিন ও নেপালি টাইমস অবলম্বনে- দৈনিক নয়াদিগন্ত ৩০/১১/২০১৩ এবং ০২/১২/২০১৩ইং
প্রকাশিত।