অপ্রিয় সত্য
![]() |
অপ্রিয় সত্য |
আমার লাশ শহীদ মিনারে যাবে না!
আমরা সবাই হাঁটছিলাম হুমায়ুন আহমেদের
নুহাশ পল্লীর সবুজ চত্বরে। দিনটি ছিল শুক্রবার আর তারিখ ছিল ১৭ই অক্টোবর ২০১৪। সময়
তখন সকাল ১১টা। নুহাশ পল্লীর ম্যানেজার এবং কর্মচারীরা হয়তো আগে থেকেই জানতেন যে, তিনি এবং আমি আসছি। আর
তাই সেখানে পৌঁছা মাত্র তাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা আমাকে আপ্লুত করে। হুমায়ুন আহমেদ
বেঁচে থাকতে বহুবার চেষ্টা করেছি সেখানে যেতে- কিন্তু হয়ে ওঠেনি। তার শাশুড়ি তহুরা
আলী আমার ঘনিষ্ঠজন হবার কারণে পারিবারিক পরিবেশে তার সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ ছিল।
সময় যখন পেলাম-তখন সবকিছু ছিল কেবল হুমায়ুন আহমেদ ছাড়া। ঘটনার দিন আমাদের মুল
পরিকল্পনা ছিল গাজীপুরের হোতা পাড়ায় গিভেন্সী গ্র“প
পরিচালিত বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র পরিদর্শনের। আমি তো হোমরা চোমরা গোছের কেউ
নয়-৩/৪টি পত্রিকায় রাজনৈতিক কলাম লিখি - আর একটি পত্রিকায় লিখি দুইটি ধারাবাহিক
ঐতিহাসিক উপন্যাস। একটির নাম মোঘল হেরেমের দুনিয়া কাঁপানো প্রেম এবং অন্যটি হল;
আরব্য রজনীর মহানায়ক। এর বাইরে টেলিভিশন টক শো, সভা সমিতি সেমিনার এবং ওয়াজ মাহফিলে বক্তা হিসেবে টুকটাক অংশ গ্রহণ। এই
সুবাদে দেশের কিছু লোকজন হয়তো আমাকে চিনেন। কিন্তু তারা যে আসলে আমাকে কিভাবে
চিনেন সে ব্যাপারে আমার নিজেরই বহুত সংশয় আছে। কারণ আমার লেখা এবং বক্তৃতার সংগে
যেমন সহমত পোষণ করেন এমন লোকজন আছেন তেমনি অপছন্দকারীর সংখ্যাও নেহায়েৎ কম নয়। ফলে
নিজেকে নিয়ে আমার আত্মতৃপ্তি বা গর্ব অনুভব করার কোন সুযোগ আমি পাইনি। এমন অবস্থায়
রিনা পারভিন নামের এক আইনজীবী আমাকে একদিন ফোন দিলেন-
রিনার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিলো বিগত
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের সময়। সে তখন গাজীপুর সদর উপজেলার নির্বাচিত
মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান। পেশায় জেলা বারের একজন আইনজীবী। এক সময় ব্যারিস্টার রফিকুল
হকের সহকারী ছিল। বর্তমানে সে গিভেন্সী গ্র“পের লিগ্যাল এডভাইজার। ফোন করে রিনা জানালো যে,
গিভেন্সী গ্র“পের মালিক খতিব মুকুল
সাহেব আমাকে একটু দাওয়াত দিতে চান তার বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রটি পরিদর্শন করার
জন্য। আমি মুকুল সাহেব, গিভেন্সী গ্র“পকে যতটা না চিনতাম-তার চেয়েও বেশী চিনতাম তার বয়স্ক পুনর্বাসন
কেন্দ্রটি। কারণ এটি বাংলাদেশের একটি অনন্য সাধারণ দাতব্য প্রতিষ্ঠান যা কিনা
স্বয়ং মাদার তেরেসা এসে উদ্বোধন করে গেছেন। প্রায় ৪০০ বিঘা জায়গার ওপর গড়ে ওঠা
বিশাল একটি মহতী প্রতিষ্ঠানে ৩০০ শত বয়স্ক নারী পুরুষ সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে
থাকা-খাওয়া, চিকিৎসা, পোশাকাদিসহ
সবকিছু পাচ্ছেন সেই ১৯৮৭ সাল থেকে। মুকুল সাহেব ফোন করে দাওয়াত দিলেন। তিনি
জানালেন যে, ব্যারিস্টার রফিকুল হক এবং আমি নাকি তার
পছন্দের অতীব পছন্দের লোক। তার ইচ্ছা আমরা যেন তার প্রতিষ্ঠানটি একটু ঘুরে যাই এবং
তার সঙ্গে দুপুরে দুটো ডাল ভাত খাই। আমি বিনা বাক্যে রাজি হয়ে গেলাম। একটি ভালো
কর্ম দেখার জন্য যাচ্ছি বিধায় স্ত্রীকেও সঙ্গে নিয়ে গেলাম। উত্তরা পৌঁছে
ব্যারিস্টার রফিক এবং রিনার সঙ্গে একত্র হলাম। জনাব হকের সঙ্গে আমার পরিচয় বহু
দিনের কিন্তু আন্তরিকতা ও সহমর্মিতা সৃষ্টি হয়েছে আমার কারাবাসের পর। তিনি যে আমায়
এতো ভালোবাসেন তা আমি ইতিপূর্বে জানতাম না। তিনি দেশের একজন সিনিয়র আইনজীবী। গত
১/১১র সময়ে তাঁর সাহস, ব্যক্তিত্ব এবং সফলতা তাঁকে
দেশবাসীর নিকট কিংবদন্তীতে পরিণত করেছে। তাঁর সঙ্গে ইতিপূর্বে কয়েকটি টকশো,
সেমিনার, টেলিভিশনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী
এবং দূতাবাসের অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিলো। সেখানে কথা হতো এবং প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে
তিনি মতামত রাখতেন এবং শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন। জেল থেকে বেরুনোর পর একটি দূতাবাসের
জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানে গিয়ে ব্যরিস্টার হকের কথা শুনে আমার চোখ অশ্রু“সজল হয়ে গেলো। আমি দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে- আর তিনি
গল্প করছিলেন অদূরে বসে তার মানের কয়েকজন সিনিয়র সিটিজেনের সঙ্গে। আমি ভাবছিলাম
একটু এগিয়ে গিয়ে তাঁকে সালাম দিয়ে আসব কিনা! আমার ভাবনার মাঝে তাঁর সঙ্গে দৃষ্টি
বিনিময় হতেই তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে আমার নিকট চলে এলেন। আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন -
”বাবা কেমন আছ! তুমি যখন জেলে গিয়েছিলে তখন আমি দেশের
বাইরে ছিলাম। ফিরে আসার পর সব কিছু শুনে খুব খারাপ লাগলো। একদিন জেল খানাতেও
গিয়েছিলাম। তোমার সঙ্গে দেখা না করেই চলে এসেছি। কারাগারের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে
ভেবেছি- কিভাবে এবং কোন আইনে রনিকে ভেতরে ঢোকানো হল। তোমার জন্য মনে হয় নতুন করে
আইন পড়তে হবে. . . .. . ।” ঐ দিনের পর থেকে তিনি আমার
হৃদয়ে আসন নিলেন একজন সম্মানিত পিতা হিসেবে। উত্তরাতে রিনাদের বাসার নীচতলায়
আমাদের দেখা হল। তিনি বললেন - যদি সময় থাকে তবে চলো একটু নুহাশ পল্লী দেখে আসি।
আমরা সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম। উত্তরা থেকে যাত্রা করার দেড় ঘণ্টা পর আমরা প্রয়াত
হুমায়ুন আহমেদের নুহাশ পল্লীতে গিয়ে পৌঁছালাম। প্রায় ৪০ বিঘা জায়গা নিয়ে অতীব যতন
সহকারে লেখক তাঁর নির্জন এবং নিভৃত পল্লীটি গড়ে তুলেছেন। সেখানকার সব কিছুতেই
হুমায়ুন আহমেদের ব্যক্তিগত রুচি, আভিজাত্য, পছন্দ, মেধাও মননশীলতার ছাপ রয়েছে। হুমায়ুন কি
করতেন-কখন করতেন, কিভাবে করতেন তা যেন সব নুহাশ পল্লীর
সবুজ চত্বর, বৃক্ষরাজি এবং পাক-পাখালী- আগ বাড়িয়ে
দর্শনার্থীদের কানে কানে বলে দিচ্ছিল। এখানকার প্রতি ইঞ্চি ভূমি, প্রতিটি উদ্ভিদ, পুকুর, ঘরবাড়ি, স্থাপত্য এবং পায়ে হাঁটা সরু পথের গতি
প্রকৃতির মধ্যে মানুষ হুমায়ুনকে খুঁজে বেড়ায়- আর সবচেয়ে বেশী খুঁজে তার প্রেয়সী
মেহের আফরোজ শাওনকে।
আমরা যখন নুহাশ পল্লীর ভেতর দিয়ে
হাঁটছিলাম তখন আরও ১০/১২টি পরিবারকে দেখলাম ঘোরা ফেরা করতে। স্থানীয় কিছু যুবক
যুবতী, ছাত্র-ছাত্রী মিলিয়ে
প্রায় শ’ খানেক লোক তো হবেই। তাদের অনেকে আবার বাড়ী থেকে
খাবার নিয়ে এসেছিলো। ঘোরা ঘুরির পর কোন এক গাছের নীচে বসে সেই খাবার খেতে খেতে
উৎসুক নয়নে আশে পাশে তাকাচ্ছিল আর ভাবছিল- হুমায়ুন তো মারা গেছেন। কিন্তু তার
প্রেয়সী কই! তিনি কেন সব সময় নুহাশ পল্লীতে থেকে হুমায়ুন ভক্তদের দেখা দেন না!
ব্যারিস্টার রফিকুল হক নুহাশ পল্লীতে এসে ভারী মজা পেলেন। তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে
সেখানকার ম্যানেজারকে নানা কথা জিজ্ঞাসা করতে করতে পুকুর পাড়ে এসে উপস্থিত হলেন।
ম্যানেজার বললেন- ঐ যে ঘরটি দেখছেন! ওখানে বসে স্যার গভীর রাতে ভূত দেখতেন।
ম্যানেজারের কথা শুনে তিনি তো ভারী অবাক হয়ে গেলেন। আমি হুমায়ুন আহমেদ, তার পারিবারিক জীবন, চিন্তা চেতনা এবং ভূত
সম্পর্কে আমার জানা নানা কল্প কাহিনী বলে তাকে আনন্দ দেবার চেষ্টা করলাম।
নুহাশ পল্লীর যে ঘরে বসে হুমায়ুন আহমেদ
লিখতেন আমাদেরকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হল। আমরা মেঝেতে বিছানো কার্পেটের ওপর আয়েশি
ঢংয়ে বসে এমন একটি আড্ডা জমানোর চেষ্টা করলাম ঠিক যেমনটি হয়তো হুমায়ুন আহমেদ
জীবৎকালে করতেন। নানা রং রসের কথা হল। হাসি তমসা, খুনসুটির পর দেশী পেঁপে,
সবজী, মাংস, লুচি
এবং চা পর্বের মাধ্যমে নাস্তার কাজটি সেরে রওয়ানা হলাম গিভেন্সী গ্র“পের বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের দিকে। যেতে যেতে রিনা বলতে আরম্ভ করলো
নুহাশ পল্লীর প্রথম দিককার কাহিনী। সে ঐ গ্রামের মেয়ে বিধায় সব কিছু ছিল তার
নখদর্পণে। হুমায়ুন আহমেদের মাধ্যমেই বলতে এলাকাটির আবাদ হয়। তিনি যখন প্রথম জমি
কিনেছিলেন তখন হয়তো প্রতি বিঘার দাম ছিল ১০/১২ হাজার টাকা। সর্বশেষে লাখ টাকা দরে
কিনেছিলেন। আর এখন সেই জমির মূল্য প্রতি বিঘা কমপক্ষে ৫০ লাখ। নুহাশ পল্লীর কাজ
শুরু হলে ঢাকার অতিথিদেরকে অনেকখানি পথ গরুর গাড়ীতে করে আসতে হতো। গ্রামে
রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ এবং গরুর গাড়ি ভিন্ন অন্যকোন যানবাহনই
ছিল না। ফলে ঐ এলাকার আপামর জনগণ তাদের সার্বিক উন্নয়নের জন্য হুমায়ুন আহমেদকে সব
সময় স্মরণ করে থাকে। রিনার কথা শুনতে শুনতে আমরা গিভেন্সী গ্র“পের বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের মূল ফটকে উপস্থিত হলাম। সুবিশাল গেইট,
অনেক নিরাপত্তা রক্ষী এবং নিয়ম কানুনের বেশ কড়াকড়ি লক্ষ করলাম।
আমাদের পরিচয় জানার পর আমাদেরকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হল। গাড়ী চালিয়ে
অনেকখানি পথ চলার পর আমরা পুনর্বাসন কেন্দ্রের অফিসের সামনে পৌঁছলাম। জনাব মুকুল
তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। আমরা গাড়ী
থেকে নামলাম এবং মুকুল সাহেবের অফিসে গিয়ে বসলাম। পূর্বেই বলেছি বিরাট ব্যাপার-
এলাহি কাণ্ড। প্রায় ৪০০ বিঘা জায়গার ওপর গড়ে তোলা পুনর্বাসন কেন্দ্রটিতে ৩০০ জন
বয়স্ক নারী পুরুষের বাস। কোন দেশী বিদেশী সাহায্য নেই। চলছে একক দানে। আশ্রয়
প্রাপ্ত নারী পুরুষের জীবনের সকল চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি তাদের মৃত্যুর পর তাদের
ওছিয়ত অনুযায়ী দাফন কাফনের ব্যবস্থা করা হয়। প্রকল্পের ভেতরেই রয়েছে নিজস্ব
কবরস্থান। পুকুরে মাছ চাষ হচ্ছে- খামারে হাঁস-মুরগীসহ গবাদি পশু। উৎপাদিত হচ্ছে
ধান, গম, তরি তরকারী এবং ফলমূল।
আশ্রয় প্রাপ্তদের অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা,
বিনোদন, শিক্ষা-দীক্ষা, শরীর চর্চা, ধর্ম-কর্ম-সকল কিছুরই ব্যবস্থা
করা হচ্ছে সুচারুভাবে। আমরা পুরো প্রকল্প ঘুরে দেখতে দেখতে এসব বিষয় অবগত হলাম এবং
একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত ঔদার্য দেখে যারপর নাই মুগ্ধ হলাম। আমরা লক্ষ করলাম যে,
সকল বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা গভীর আবেগ সহকারে মুকুল সাহেবকে বাবা বলে
সম্বোধন করেন। আমাদের মতো আরেক দল মধ্য বয়সী ভদ্র মহিলারাও সেদিন পুনর্বাসন
কেন্দ্রটি দেখতে গিয়েছিলেন। তারা সবাই রাজধানীর অভিজাত এলাকা বারিধারার বাসিন্দা
এবং একটি সামাজিক সংস্থার সদস্য। তাদের সংখ্যাও ছিল প্রায় ২০/২২ জন। পরিদর্শন শেষে
আমরা সবাই এক রুমে বসে প্রকল্পটির আদি অন্ত নিয়ে আলোচনা শুরু করলাম। মুকুল সাহেব
জানালেন - কিভাবে তিনি কত কষ্ট করে শুরুটা করেছিলেন সেই ১৯৮৭ সালে যখন তিনি সবে
ধনবান হয়েছেন কিন্তু তখনো পর্যন্ত বিয়ে থা করেননি। বহু সম্মানজনক মধুর স্মৃতির
পাশাপাশি গুটি কয়েক বিব্রতকর পরিস্থিতির কথাও অকপটে বললেন। বললেন ভবিষ্যৎ
পরিকল্পনার কথা। নানা জনের নানা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন তিনি। একজন বললেন আচ্ছা
এখানে আশ্রয়প্রাপ্তদের বেশির ভাগ মহিলা কেন। তিনি যেইনা বলতে আরম্ভ করলেন যে,
আমাদের সমাজটা পুরুষ নিয়ন্ত্রিত ওমনি তার রসিক এবং বিদুষী স্ত্রী
দাঁড়িয়ে অবজেকশন দিয়ে বসলেন। মিসেস মুকুল বললেন- আমাদের সমাজ কোন মতেই পুরুষ
নিয়ন্ত্রিত নয়- গত ২৪টি বছর আমাদের রাষ্ট্র নারী কর্তৃক শাসিত হচ্ছে। আমাদের নারী
শাসকদের সামনে কোন পুরুষই মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর ক্ষমতা রাখে না। এ কথা বলেই
তিনি অভিনয় করে দেখিয়ে দিলেন বেগম খালেদা জিয়া কিংবা শেখ হাসিনার রুমে ঢোকার
পূর্বে একজন পুরুষ কিভাবে হাঁটে এবং রুমে ঢোকার পর তার সামনে যেতে স্বল্পতম
দূরত্বটুকু অতিক্রম করতে গিয়ে কিভাবে হাঁটে। আমরা সবাই হো হো করে হেসে উঠলাম।
আলোচনা চলে গেলো রাজনীতির ময়দানে। জনাব মুকুল বেকার হয়ে পড়লেন আর আমি হলাম নানা জনের
নানা প্রশ্নের উত্তর দাতা। ঘটনার দিন একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিল প্রয়াত অধ্যাপক
ডঃ পিয়াস করিমের লাশ ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য নেয়া
এবং প্রতিপক্ষ কর্তৃক বাধা দেয়া প্রসঙ্গে। পিয়াস করিমের পরিচিতি মূলত টেলিভিশনের
টকশোর কল্যাণে। আর ঐ ক্ষেত্রে অল্প কয়েকজন আলোচিত জনের মধ্যে তারা আমাকেও মনোনীত
করলেন এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আমার মন্তব্য জানতে চাইলেন। আমি কোন উত্তর না দিয়ে
ব্যারিস্টার রফিকুল হকের দিকে তাকালাম। তিনি তার স্বভাব সুলভ হাস্যরসে নিম্নের
জবাবটি দিলেন ”এখানে উপস্থিত সকলের মধ্যে আমিই বয়োবৃদ্ধ।
ফলে মৃত ব্যক্তির লাশ নিয়ে কথা বলার অধিকার আমারই সবচেয়ে বেশি। যারা পিয়াস করিমের
লাশ শহিদ মিনারে নিয়ে সম্মান দেখানোর জন্য জিদ করেছেন এবং যারা বাধা দিয়েছেন তাদের
উভয় পক্ষের নিকট একটি প্রশ্ন করা যেতে পারে- কেন তারা ওখানে লাশ নিতে চাচ্ছেন এবং
কেনই বা বাধা দেয়া হচ্ছে। পিয়াস করিম কি ওছিয়ত করে গিয়েছিলেন যে, আমার লাশটি শহীদ মিনারে নিয়ে যেও! আবার যারা বাধা দিচ্ছেন তারা কি বলতে
পারবেন যে, শহীদ মিনার তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি বা
পারিবারিক সম্পত্তি! এসব বিতর্ক এবং গণ্ডগোলের পর কোন ভদ্র লোকের লাশ হয়তো আগামী
দিনে শহীদ মিনারে নেয়া হবে না। অনেকে মৃত্যুর পূর্বে পরিবার পরিজনকে বলে যাবে -
আমার লাশ যেন ওখানে নেয়া না হয়।” একজন ভদ্র মহিলা প্রশ্ন
করলেন- স্যার আপনি তো সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি! আপনার ক্ষেত্রে কি হবে। তিনি বললেন
-আমার লাশ শহীদ মিনারে যাবেনা। বায়তুল মোকারÍমে জানাজার
পর সোজা আমার গ্রামের বাড়ীতে। আমার প্রয়াত স্ত্রীর পাশে অনেক আগেই কবর খুঁড়ে
রেখেছি। সব কিছু ঠিকঠাক। মৃত ব্যক্তির নাম, পিতার নাম,
জন্ম তারিখ সব কিছুই লিখা রয়েছে। কেবল মারা যাবার তারিখটি শূন্য
রয়েছে। ঐ শূন্য স্থান পূরণের জন্য প্রতি দিন একটু একটু করে মরণের দিকে এগোচ্ছি।
তাঁর এই বক্তব্যের পর পুরো ঘরে কেমন যেন এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এলো। আমি আমার
সম্মানিত পিতৃবৎ অভিভাবকের মুখের দিকে তাকালাম। তিনি কিছুটা উদাস! মনে হল- তার
প্রয়াত স্ত্রী এবং কবরের স্থানটি হয়তো বা মানষপটে ক্ষণিকের তরে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে।