অপ্রিয় সত্য
বেশ সহজ একটা যুক্তি, জামায়াত
একবার আওয়ামীলীগ আরেকবার বিএনপির সাথে জোট করেছে! তাই এরা মুনাফিক, ক্ষমতার জন্য জামায়াত সব করতে পারে। এই ধরনের যুক্তি হয় অজ্ঞরা দেয়
আর না হয় বুঝেশুনে মানুষকে ধোঁকা দেয়ার জন্য কিছু লোক বলে বেড়ায়। অথচ, প্রকৃত
অর্থে জামায়াত নয়, বিএনপি-আওয়ামীলীগই একবার জামায়াতের
সাথে গেছে আরেকবার ছেড়ে গেছে। কেন ছেড়ে গেছে? ক্ষমতার
জন্য! আর ইতিহাস তাই বলে।
বাংলাদেশে ঐক্যবদ্ধ রাজনীতিতে
জামায়াতের সূচনা হচ্ছে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে। ১৯৮১ থেকে বিএনপি-লীগ-জামায়াতের
ঐক্যবদ্ধ গণতন্ত্রের দাবিতে দীর্ঘ নয় বছরের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের
পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ সরকারের পতন ঘটে। কিন্তু বিপত্তি বাধে
নির্বাচন নিয়ে। কে এই নির্বাচন পরিচালনা করবে? সবাই এর আগে দলীয় অধীনে নির্বাচনের
রূপ দেখেছেন, তাই কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে রাজী ছিলেন না।
এই সমস্যার সমাধান নিয়ে আসেন জামায়াতের অধ্যাপক গোলাম আযম। নির্দলীয় নিরপেক্ষ
তত্ত্বাবধায়ক সরকার এর অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, সব
দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ অস্থায়ী
প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন৷ শাহাবুদ্দিন আহমদের অধীনে ১৯৯১ সালে
পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বিএনপি সবচেয়ে বেশি আসন
পেয়ে সরকার গঠন করে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এই নির্বাচনে
সূক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ আনেন। কিন্তু তিনি এই নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়ে শপথ
গ্রহণ করেন। জামায়াত ১৮টি আসনে জয়লাভ করে। বিএনপি সরকার গঠন করার কিছুদিন পর থেকেই
বিরোধী দলগুলো সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংযোজনের জন্য সরকারকে চাপ
দিতে থাকে৷
সর্বপ্রথম জামায়াত এবং তারপর
আওয়ামী লীগ ১৯৯৩ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত বিল সংসদ সচিবালয়ে পেশ করে৷
এতে বলা হয়, জাতীয় নির্বাচনকে অবাধ ও নির্বাচনের সামগ্রিক প্রক্রিয়াকে ক্ষমতাসীন
দলের প্রভাবমুক্ত করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধানে সংযোজন করা
উচিত৷ কিন্তু বিএনপি প্রথম থেকেই এ দাবি অসাংবিধানিক বলে অগ্রাহ্য করতে থাকে। ১৯৯৪
সালের ২৭ জুন সংসদ ভবনে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে
আওয়ামী লীগ, জামায়াত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের
রূপরেখা ঘোষণা করে৷ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ওই রূপরেখাকে অসাংবিধানিক
ও অবাস্তব বলে ঘোষণা করেন৷ বেগম জিয়া বলেন, একমাত্র
পাগল ও শিশু ছাড়া কোন মানুষের পক্ষে নিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব নয়। কমনওয়েলথ মহাসচিব
সরকার ও বিরোধী দলগুলোর মাঝে সমঝোতার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন৷ এরপর নভেম্বরে
কমনওয়েলথ মহাসচিবের প্রতিনিধি স্যার নিনিয়ান সমঝোতা প্রচেষ্টা চালান৷ তিনিও
ব্যর্থ হন।
৬ ডিসেম্বর ১৯৯৪ জামায়াত ও
আওয়ামী লীগ আলাদা সমাবেশ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নেয়ার জন্য
সরকারকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দেয়৷ সরকার তার অবস্থানে অনড় থাকায় ২৮
ডিসেম্বর বিরোধী দলের ১৪৭ জন সংসদ সদস্য পদত্যাগপত্র পেশ করে৷ ২৩ ফেব্রুয়ারি
স্পিকার তাদের পদত্যাগপত্র গ্রহণযোগ্য নয় বলে রুলিং দেন। ১৯৯৫ সালের ১৯ জুন
বিরোধী সংসদ সদস্যদের পরপর ৯০ কার্যদিবস সংসদে অনুপস্থিতি পূর্ণ হয়। এতে সংসদে
তাদের আসন শূন্য হবে কি-না এ নিয়ে বিতর্কে সরকারি দল ও স্পিকারের মাঝে মতদ্বৈধতা
দেখা দেয়। এ অবস্থায় প্রেসিডেন্ট সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ মোতাবেক পদত্যাগী সংসদ
সদস্যদের আসন শূন্য হবে কিনা জানতে চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের কাছে পরামর্শ চান৷
সুপ্রিম কোর্ট পদত্যাগী সংসদ সদস্যদের আসন শূন্য হওয়ার পক্ষে মত দেন৷ ৩১ জুলাই
১৯৯৫ সংসদ সচিবালয় থেকে ৮৭ জন বিরোধী সংসদ সদস্যর আসন শূন্য বলে ঘোষণা করা হয়৷
এছাড়া যে ৫৫ জন বয়কটকালে হাজিরা খাতায় সই করেছিলেন তাদের সংসদ সচিবালয় থেকে
চিঠি দিয়ে জানতে চাওয়া হয়, যেদিন তারা হাজিরা খাতায় সই
করেছিলেন সেদিন বৈঠকে তারা উপস্থিত ছিলেন কি-না৷ সংসদ সদস্যরা এ চিঠির কোনো উত্তর
দেননি৷ অবশেষে ৭ আগস্ট ওই ৫৫ জনের আসনও শূন্য ঘোষণা করা হয়৷ নির্বাচন কমিশন ১৪২টি
শূন্য আসনে ১৭ সেপ্টেম্বর উপ-নির্বাচনের ঘোষণা দেয়৷ পরে বন্যার কারণে
উপ-নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে ১৫ ডিসেম্বর ধার্য করা হয়৷ কিন্তু বিরোধী দলগুলো
নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়৷ তারা সরকারের পদত্যাগ, সংসদ
বাতিল ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ২ সেপ্টেম্বর থেকে একটানা
৩২ ঘণ্টা হরতাল পালন করে৷ ৬ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনা আবার প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে
তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের প্রস্তাব দেন। প্রধানমন্ত্রী এ প্রস্তাব অসাংবিধানকি ও অযৌক্তিক বলে বাতিল করে দেন৷ প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলগুলোকে আলোচনার
জন্য ডাকেন৷ কিন্তু বিরোধী দলগুলো আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে৷ এরপর ১৬
নভেম্বর ১৯৯৫ থেকে একাধারে ৭ দিন হরতাল পালিত হয়া
হরতাল আর অবরোধের ফলে দেশের
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি চরম দুরবস্থার মুখোমুখি হয়৷ সরকার উপ-নির্বাচনে না
গিয়ে ২৪ নভেম্বর জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দেয় এবং ১৮ জানুয়ারি ১৯৯৬ সাধারণ
নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়৷ পরে তৃতীয়বারের মতো তারিখ পরিবর্তন করে নতুন
তারিখ দেয়া হয় ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি৷ সব বিরোধী দল এ নির্বাচন বর্জনের
ঘোষণা দেয়৷ বিরোধী দলগুলোর প্রতিরোধের মুখে ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ
নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়৷ দেশব্যাপী সহিংসতায় কমপক্ষে ১৫ জন নিহত হয়৷ সারা দেশ
রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলায় নিপতিত হয়৷ ২৪, ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিরোধী দলের
আহ্বানে দেশব্যাপী অসহযোগ পালিত হয়৷ ৩ মার্চ জাতির উদ্দেশে ভাষণে খালেদা জিয়া
ষষ্ঠ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল আনার ঘোষণা দেন৷
কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় ষষ্ঠ সংসদ বাতিল ও পদত্যাগ সম্পর্কে কোনো কথা না
থাকায় বিরোধী দলগুলো তাদের আন্দোলন অব্যাহত রাখে৷ ৬ মার্চ হরতাল ডাকা হয়৷ ওই দিন
সিরাজগঞ্জ-৩ আসনের পুনঃ-নির্বাচনে সহিংসতায় ৯ জন নিহত হয়৷ এরপর ৯ মার্চ থেকে
সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত বিরোধী দলগুলো লাগাতার অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে৷ এই
অসহযোগের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে রাষ্ট্রপতি সংলাপ আহ্বানের জন্য বিরোধী
দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় করেন৷ প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর চিঠি বিনিময়
হয়৷ পাঁচ বুদ্ধিজীবী বিভিন্নভাবে সমঝোতার চেষ্টা করেন৷ কিন্তু সব প্রচেষ্টা
ব্যর্থ হয়।
২৩ মার্চ প্রেস ক্লাবের সামনে
সচিবালয়ের সরকারবিমুখ কর্মকর্তারা তাদের চাকুরীর নিয়ম ভঙ্গ করে জনতার মঞ্চ
স্থাপন ও সরকার পদত্যাগ না করা পর্যন্ত অবস্থান ধর্মঘটের ডাক দেয়। অসহযোগ
আন্দোলনের মাঝেই ১৯ মার্চ খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রীপরিষদ গঠিত হয় এবং
ষষ্ঠ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে৷ কিন্তু সারা দেশে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা শুরু হয়৷
সরকার মার্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল সংসদে উত্থাপন করে৷ ২৬ মার্চ সরকার
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল জাতীয় সংসদে পাস হয়৷ ২৮ মার্চ সচিবালয়ের
ভেতরে ১৪৪ ধারা জারি করে এবং সচিবালয়ের ভেতরে-বাইরে সেনাবাহিনী, পুলিশ
মোতায়েন করেও বিক্ষুব্ধ সচিবালয়কে নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার ব্যর্থ হয়৷ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে
৩০ মার্চ রাষ্ট্রপতি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয় এবং খা-লেদা জিয়া পদত্যাগ করেন৷
রাষ্ট্রপতি সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবর রহমানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের
প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করেন৷
১৯৯৬ এ জামায়াত এককভাবে
নির্বাচন করেছিলো। ৯১ এ যেখানে আসন সংখ্যা পেয়েছিল ১৮ টি সেখানে ৯৬ এ পায় ৩ টি।
বিএনপি ও সেই অবস্থার মুখোমুখি হয়। জনপ্রিয়তা শূন্যের কোটায় নেমে আসা আওয়ামীলীগ, যারা ৮৬ তে
প্রথমে অস্বীকার করে পরে ক্ষমতার লোভে নির্বাচন করেছিলো তারা নিজ কৃতকর্মের জন্য
তওবা করে হাতে তসবি, মাথায় পট্টি বেঁধে ভোট চেয়ে এগিয়ে
গেল। এই শাসনামলেই খালেদা জিয়া টের পান শেখের বেটি হাসিনা ক্যেয়া চিজ হ্যাঁয়!
পরপুরুষের চুমু খাওয়া, প্রকাশ্যে মদ্যপান, মাথায় তিলক নেয়া সহ বায়তুল মোকাররমে পুলিশ কর্তৃক গুলি-জুতা পায়ে
প্রবেশ, আলেম হত্যা-নির্যাতন, মাদ্রাসায়
তালা লাগানো, শেখ মুজিবের ছবি দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে টাঙ্গানো............ আর কতকিছু মানুষ চোখে
দেখার সুযোগ পায়। (এখনো পাচ্ছে!)
খালেদা এতো দিনে বুঝাতে সক্ষম
হয়েছেন যে জনগণের ম্যেন্ডেট নিয়েই ক্ষমতায় যেতে হবে, আর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ছাড়া হাসিনাকে
হটানো অসম্ভব। গঠন করা হয় চার দলীয় ঐক্য জোট, যার মধ্যে
ইসলামী দল ছিল- জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট,
খেলাফত মজলিশ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম। এর পরের ইতিহাসতো সকলেরই জানা।
একটু চিন্তা করে দেখবেন কি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার কারা পেশ করেছে? আওয়ামীলীগ
কেন জামায়াতের সাথে, কি উদ্দেশ্যে আন্দোলন করেছে? বিএনপিই বা কেন জামায়াতকে টেনে নিয়েছে?
উত্তর স্পষ্ট: নিজেদের
স্বার্থে; জামায়াত
শুরু থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার চেয়ে আসছে আর বিএনপি একবার এই দাবি নিয়ে জামায়াতের
সাথে থেকেছে আরেকবার আওয়ামীলীগ। ২০০১ এর আগে জামায়াত তিনবারই সরকার বিরোধী ছিল।
তারা ক্ষমতা লোভী হলে ৯১ এর সরকার থেকে বেরিয়ে আসতো না, ৯৬
এর আগে পরে আওয়ামীলীগের সাথে থাকতো। আরেকটা কথা, বিরোধিতা
কি শুধু জামায়াতের জন্য প্রযোজ্য? ইসলামী দল গুলোর তালিকা
অনেক দীর্ঘ; যাদের জন্য নারী নেতৃত্বও হালাল, জোট করাও হালাল।